বিংশ একবিংশ
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিংশ শতাব্দী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী বিশেষত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে, এটি অন্য সকল শতাব্দীর সম্মিলিত অগ্রগতির চেয়েও বেশি। কেবল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ অগ্রযাত্রা অত্যন্ত সফল ও সক্রিয় ছিল। অসংখ্য কবি, শিল্পী, দার্শনিকের কর্ম-কীর্তিতে উজ্জ্বল এ শতবর্ষ। বিংশ শতাব্দী-জাত এ উদ্দাম অগ্রগতি একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেবল স্বাভাবিক সচল নয় বরং অশ্ববেগে ছুটছে। অবশ্য এ প্রগতির ফলে যে মানুষের শারীরিক মানসিক দুদিকের উন্নতি এসেছে কিংবা এর ফলে যে সকল মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তা কিন্তু নয়। আসলে বিশ্বায়ন-ব্যবস্থায় সবকিছুকে পণ্যের উন্মুক্ত বাজারে উপস্থাপন করা হলেও, সে পণ্য আর তৃতীয় বিশ্বের বিপন্ন মানুষের ভোগের বিষয় থাকেনি। দেখা গেছে, যারা নির্দিষ্ট একটি পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তারাও সেটি ভোগ করতে পারছে না। অন্যদিকে যে বিশ্বায়নের অলীক গল্প পাঠ হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে, বলা হচ্ছে পৃথিবী একক-দেশ তথা বিশ্বগ্রাম অথচ যোগাযোগের উল্লম্ফন ছাড়া বিশ্বের সকল প্রান্তে উন্নতির ছিঁটেও পড়েনি বরং প্রান্ত থেকে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে শস্য ও রত্নরাজি। আর দেশে দেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তো যুদ্ধ-সংঘাত লেগেই রয়েছে। যুদ্ধ, সংঘাত ও অসমতার হাত থেকে মুক্তি মিলছে না মানুষের। বিংশ একবিংশ শীর্ষক রচনায় এসব কিঞ্চিৎ বিস্তারে তুলে ধরে মোটাদাগে যে কথাটি বলতে চেয়েছি তা হলো: যোগাযোগ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন তো হলো, এখন মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন— ভালোবাসা ও মানবতার বিশ্বায়ন। ‘ভালোবাসা সশস্ত্র হলে যুদ্ধ থেকে যায়।’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অনেক সৃজন-প্রকরণের প্রবর্তক। তাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা প্রবেশ করেছে আধুনিক যুগে। দগ্ধ-অনুতপ্ত প্রাণের গ্রন্থনা করেছেন তিনি ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় আর এই সংরক্ত কাব্যকথনই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম স্মারক। দ্বি-শত জন্মবর্ষে মধুকবিকে তাঁর সৃষ্টিকর্মের শোভাকীর্তনে ও জীবন বিলাপের মর্মে একটুখানি স্মরণের চেষ্টা করেছি ‘মধুসূদনের আত্মবিলাপ’ শিরোনামের রচনায়। বাংলা কবিতার অগ্রবর্তী দিকপাল কবি জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক মানসকে তিনি যে গভীর তাৎপর্যে ও সুনিপুণ শিল্পশোভায় তুলে ধরতে পেরেছেন, তা বিপুলভাবে জানান দিচ্ছে আজকে সর্বত্রব্যাপী তাঁর কাব্যের পাঠ ও পর্যালোচনাসমূহ। জীবনানন্দের বিখ্যাতসহ কবিতা নিয়ে অদ্যাবধি কম কথা হয়নি। তার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম উচ্চারিত, কম চর্চিত ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের জীবন কবিতাগুচ্ছ। এ স্বল্পায়তনিক কবিতাগুলোতে জীবন ও মৃত্যুর দ্বিবিধ আচার ও আয়োজন দার্শনিকের বীক্ষণ ও অনুচিন্তনে অথচ শিল্পের সৌম্য-শাসনে অত্যন্ত মনোময় ভাষণে ওঠে এসেছে, এ নিয়ে ‘জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথ’ রচনায় সামান্য পর্যালোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বাংলা কবিতা ও বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম। প্রচণ্ড আবেগ, স¦জাত্যবোধ, সাহসিকতা ও প্রেমিকহৃদয় তাঁর কবিতা, সংগীতসহ সার্বিক রচনারাজিকে বিশেষত্ব দিয়েছে, যেখানে তাঁর কর্ম-কীর্তি সমহিমায় উজ্জ্বল। বিদ্রোহী, কেবল কাজী নজরুল ইসলামের নয় এটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কাব্য-কীর্তি। প্রকাশের পর থেকে শতবর্ষব্যাপী চর্চিত, প্রভাববিস্তারি এমন কবিতা বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে এযাবৎ অসংখ্য আলোচনা হয়েছে, প্রবন্ধ বেরিয়েছে, রচিত হয়েছে গ্রন্থ। বিদ্রোহী প্রকাশের শতবর্ষে এসে আমি ‘নজরুলের বিদ্রোহী: বিশ্ববীক্ষার অনন্য পাঠ’ রচনায় কবিতাটির শব্দে ও ভাব-মর্মে যে বিশ্ববোধ তথা মানবমুক্তি ভাবনা ধ্বনিত হয়েছে তা তুলে আনার চেষ্টা করেছি। শব্দ যে মানুষের হৃদয়ে সীমাহীন প্রেরণা জোগাতে সক্ষম, বাঙালি তার সুবিপুল সাক্ষাত পেয়েছে নজরুলের কবিতা ও গানে। ‘নজরুলের শব্দের প্রেরণা’ শীর্ষক নিবন্ধে কবির কাব্যসম্ভার থেকে বাছাইকৃত পঙ্ক্তিচয়নের মধ্যে দিয়ে চেতনার অগ্নিগিরিকে পুনরায় উন্মোচনের চেষ্টা করেছি। বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাব্যে, গদ্যে, চিত্রে ও সংগীতে প্রবহমান নদীর মতো যে অনুপম গ্রন্থনা তিনি উপস্থাপন করেছেন, ধূলি-কাদার পৃথিবীতে স্বপ্নকল্পনার যে ঊর্ধ্বমুখী বিস্তার তিনি দেখিয়েছেন, আর সৌন্দর্য বীক্ষণের যে প্রস্তাব এসেছে তাঁর রচনায় তা বাঙালির ভাব-দেহকে সমৃদ্ধ করেছে। বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথের সার্বিক রচনাকর্মেরই প্রভাব রয়েছে, তারমধ্যে বোধ করি সংগীতের প্রভাবই সবচেয়ে সুদূরবিস্তারি, তাঁর গান যে কতভাবে কতোজনকে আন্দোলিত করেছে এবং করে চলেছে, বাস্তবিকভাবে তা কোনো গবেষণার মধ্য দিয়েই তুলে আনা সম্ভব নয়। সেই শৈশব থেকে একান্তভাবে রবীন্দ্রগীতির ঐশ্বর্য যে অফুরান ভাবলোকে আমাকে আকর্ষণ করছে, তার কিঞ্চিৎ কথকতা উৎকীর্ণ রয়েছে ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ শীর্ষক রচনায়। আল মাহমুদের কবিতা বাংলাদেশের মানুষের লোকায়ত জীবন, তাদের স্বপ্ন-কল্পনা, বাক-কৌশল ও প্রাত্যহিকতার সারাৎসার। কোনো মহৎ জীবন-কৌশল কিংবা দার্শনিক বীক্ষণ না থাকলেও কেবল শব্দকৌশল ও সরল জীবনের নান্দনিক উপস্থাপনায় তাঁর কবিতা বিশেষ তাৎপর্যে বাঙালির সমাদর লাভ করেছে। বাঙালি জীবনের বহিরঙ্গও যে কত বিচিত্র বর্ণিল তার শিল্পিত রূপায়ন ঘটেছে আল মাহমুদের কবিতায়। ‘আল মাহমুদের স্বর্ণলেখা’ শীর্ষক রচনায় তাঁর কবিতার শিল্প ও লোকনন্দন পরিবীক্ষণের প্রয়াস চালিয়েছি। এস এম সুলতার হাজার বছরের কৃষি-নির্ভর বাঙালি জনজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। তাঁর চিত্র কৃষিভিত্তিক জীবন প্রবাহকে সভ্যতার বিকাশধারা হিসেবে নয় বরং সভ্যতার একটি নবরূপ হিসেবে দেখিয়েছে। এখানে কৃষকের শরীরের শক্তির সঙ্গে যেনো ভেতরের শক্তিও প্রবল বিক্রমে বিকশিত। সুলতানের শিল্পকর্মের এ তাৎপর্য অভিনব এবং এটি কেবল বাঙালির গণ্ডিসীমায় নয় বিশ্বশিল্পের ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে চিহ্নিত। ‘সুলতানের রম্য অভিনিবেশ’ শীর্ষক রচনায় শিল্পীর কর্মকৌশল ও জীবন-ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কহলীল জিবরান লেবাননে জন্মগ্রহণকারী এক অমর কবি ও শিল্পীর নাম, যাঁকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক আলোচনা হয়েছে এমনকি বাংলাদেশেও তাঁর গুণমুগ্ধ লোকের সংখ্যা কম নয়। জিবরানের বিশেষত্ব তাঁর মরমী ভাবনা এবং হৃদয়গ্রাহী উচ্চারণ শৈলী। যে কোনো প্রেক্ষিত, ধরা যাক একজন বিপন্ন মানুষ কিংবা সদ্য স্বামীহারা কোনো রমণী। জিবরান এমন করে সে রমণীর নিঃসঙ্গতাকে প্রকাশ করেছেন যেনো তা ওই রমণীর মুখের কথা নয় বরং হৃদয়ের বিদীর্ণ ভাষণ। জিবরান তাঁর প্রতিটি রচনায় এমন স্বর প্রক্ষেপণ করেছেন আর আমি সেসবে এত বেশি আক্রান্ত যে, ভূমিকাতেও একটু উদ্ধৃত না করে থাকতে পারলাম না। ‘তারপর আমি দেখলাম দুজন শ্রমিক একটা কাঠের বাক্সের ওজন বহন করছে এবং তার পেছনে এক জরাজীর্ণ চেহারার নারী যে তার নবজাত শিশুকে বহন করছে বাহুতে। তাকে অনুসরণ করছে একটা কুকুর যে তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে একবার নারীর দিকে একবার বাক্সের দিকে তাকাচ্ছে। এটা ছিল খুবই সাদাসিধে একটা অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান। মৃত্যুর অতিথি ঠাণ্ডা সমাজের উদ্দেশ্যে জাগতিক পৃথিবী পরিত্যাগ করে যায় একজন দুস্থ স্ত্রী এবং নবজাতককে তার বেদনা ভাগাভাগি করার জন্য এবং একটি বিশ্বাসী কুকুর যার হৃদয় তার সঙ্গীর চলে যাওয়া সম্পর্কে জানতো।’ উম্মে কুলসুম আরব্য রজনীর গল্পের মতোই ঘোরলাগ এক কণ্ঠশিল্পীর নাম। মিশরের লোকেরা তাদের যে কোন প্রাচীন সম্রাজ্ঞীর চেয়েও যাঁকে অধিক ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। দুজন কবির কবিতায় এ নামের উল্লেখ দেখে আমার আগ্রহ জাগে এবং তারপর দেখলাম পৃথিবীর বহু বিখ্যাত শিল্পীকে তিনি আলোড়িত করেছেন। আরবি না জানলেও কেবল সুর ও সমুদ্রের নিনাদের মতো সম্মোহনী স্বর আমাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছে, বহু রাত কেটেছে তার অপার ধ্বনি-মূর্ছনায়। ‘উম্মে কুলসুম ও তার সহস্র রাত্রির গাথা’ শীর্ষক রচনায় গায়িকার সাংগীতিক উৎকর্ষ, বিশেষত্ব এবং আরববিশ্ব জোড়া তার প্রভাব ও স্বজাত্যপ্রীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি এজন্য যে, একজন শিল্পী তার কর্মসীমার বাইরে এসে সমাজের কি বিপুল কল্যাণ সাধন করতে পারেন তা জানান দেয়ার জন্য।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিংশ শতাব্দী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী বিশেষত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে, এটি অন্য সকল শতাব্দীর সম্মিলিত অগ্রগতির চেয়েও বেশি। কেবল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ অগ্রযাত্রা অত্যন্ত সফল ও সক্রিয় ছিল। অসংখ্য কবি, শিল্পী, দার্শনিকের কর্ম-কীর্তিতে উজ্জ্বল এ শতবর্ষ। বিংশ শতাব্দী-জাত এ উদ্দাম অগ্রগতি একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেবল স্বাভাবিক সচল নয় বরং অশ্ববেগে ছুটছে। অবশ্য এ প্রগতির ফলে যে মানুষের শারীরিক মানসিক দুদিকের উন্নতি এসেছে কিংবা এর ফলে যে সকল মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তা কিন্তু নয়। আসলে বিশ্বায়ন-ব্যবস্থায় সবকিছুকে পণ্যের উন্মুক্ত বাজারে উপস্থাপন করা হলেও, সে পণ্য আর তৃতীয় বিশ্বের বিপন্ন মানুষের ভোগের বিষয় থাকেনি। দেখা গেছে, যারা নির্দিষ্ট একটি পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তারাও সেটি ভোগ করতে পারছে না। অন্যদিকে যে বিশ্বায়নের অলীক গল্প পাঠ হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে, বলা হচ্ছে পৃথিবী একক-দেশ তথা বিশ্বগ্রাম অথচ যোগাযোগের উল্লম্ফন ছাড়া বিশ্বের সকল প্রান্তে উন্নতির ছিঁটেও পড়েনি বরং প্রান্ত থেকে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে শস্য ও রত্নরাজি। আর দেশে দেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তো যুদ্ধ-সংঘাত লেগেই রয়েছে। যুদ্ধ, সংঘাত ও অসমতার হাত থেকে মুক্তি মিলছে না মানুষের। বিংশ একবিংশ শীর্ষক রচনায় এসব কিঞ্চিৎ বিস্তারে তুলে ধরে মোটাদাগে যে কথাটি বলতে চেয়েছি তা হলো: যোগাযোগ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন তো হলো, এখন মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন— ভালোবাসা ও মানবতার বিশ্বায়ন। ‘ভালোবাসা সশস্ত্র হলে যুদ্ধ থেকে যায়।’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অনেক সৃজন-প্রকরণের প্রবর্তক। তাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা প্রবেশ করেছে আধুনিক যুগে। দগ্ধ-অনুতপ্ত প্রাণের গ্রন্থনা করেছেন তিনি ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় আর এই সংরক্ত কাব্যকথনই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম স্মারক। দ্বি-শত জন্মবর্ষে মধুকবিকে তাঁর সৃষ্টিকর্মের শোভাকীর্তনে ও জীবন বিলাপের মর্মে একটুখানি স্মরণের চেষ্টা করেছি ‘মধুসূদনের আত্মবিলাপ’ শিরোনামের রচনায়। বাংলা কবিতার অগ্রবর্তী দিকপাল কবি জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক মানসকে তিনি যে গভীর তাৎপর্যে ও সুনিপুণ শিল্পশোভায় তুলে ধরতে পেরেছেন, তা বিপুলভাবে জানান দিচ্ছে আজকে সর্বত্রব্যাপী তাঁর কাব্যের পাঠ ও পর্যালোচনাসমূহ। জীবনানন্দের বিখ্যাতসহ কবিতা নিয়ে অদ্যাবধি কম কথা হয়নি। তার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম উচ্চারিত, কম চর্চিত ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের জীবন কবিতাগুচ্ছ। এ স্বল্পায়তনিক কবিতাগুলোতে জীবন ও মৃত্যুর দ্বিবিধ আচার ও আয়োজন দার্শনিকের বীক্ষণ ও অনুচিন্তনে অথচ শিল্পের সৌম্য-শাসনে অত্যন্ত মনোময় ভাষণে ওঠে এসেছে, এ নিয়ে ‘জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথ’ রচনায় সামান্য পর্যালোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বাংলা কবিতা ও বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম। প্রচণ্ড আবেগ, স¦জাত্যবোধ, সাহসিকতা ও প্রেমিকহৃদয় তাঁর কবিতা, সংগীতসহ সার্বিক রচনারাজিকে বিশেষত্ব দিয়েছে, যেখানে তাঁর কর্ম-কীর্তি সমহিমায় উজ্জ্বল। বিদ্রোহী, কেবল কাজী নজরুল ইসলামের নয় এটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কাব্য-কীর্তি। প্রকাশের পর থেকে শতবর্ষব্যাপী চর্চিত, প্রভাববিস্তারি এমন কবিতা বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে এযাবৎ অসংখ্য আলোচনা হয়েছে, প্রবন্ধ বেরিয়েছে, রচিত হয়েছে গ্রন্থ। বিদ্রোহী প্রকাশের শতবর্ষে এসে আমি ‘নজরুলের বিদ্রোহী: বিশ্ববীক্ষার অনন্য পাঠ’ রচনায় কবিতাটির শব্দে ও ভাব-মর্মে যে বিশ্ববোধ তথা মানবমুক্তি ভাবনা ধ্বনিত হয়েছে তা তুলে আনার চেষ্টা করেছি। শব্দ যে মানুষের হৃদয়ে সীমাহীন প্রেরণা জোগাতে সক্ষম, বাঙালি তার সুবিপুল সাক্ষাত পেয়েছে নজরুলের কবিতা ও গানে। ‘নজরুলের শব্দের প্রেরণা’ শীর্ষক নিবন্ধে কবির কাব্যসম্ভার থেকে বাছাইকৃত পঙ্ক্তিচয়নের মধ্যে দিয়ে চেতনার অগ্নিগিরিকে পুনরায় উন্মোচনের চেষ্টা করেছি। বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাব্যে, গদ্যে, চিত্রে ও সংগীতে প্রবহমান নদীর মতো যে অনুপম গ্রন্থনা তিনি উপস্থাপন করেছেন, ধূলি-কাদার পৃথিবীতে স্বপ্নকল্পনার যে ঊর্ধ্বমুখী বিস্তার তিনি দেখিয়েছেন, আর সৌন্দর্য বীক্ষণের যে প্রস্তাব এসেছে তাঁর রচনায় তা বাঙালির ভাব-দেহকে সমৃদ্ধ করেছে। বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথের সার্বিক রচনাকর্মেরই প্রভাব রয়েছে, তারমধ্যে বোধ করি সংগীতের প্রভাবই সবচেয়ে সুদূরবিস্তারি, তাঁর গান যে কতভাবে কতোজনকে আন্দোলিত করেছে এবং করে চলেছে, বাস্তবিকভাবে তা কোনো গবেষণার মধ্য দিয়েই তুলে আনা সম্ভব নয়। সেই শৈশব থেকে একান্তভাবে রবীন্দ্রগীতির ঐশ্বর্য যে অফুরান ভাবলোকে আমাকে আকর্ষণ করছে, তার কিঞ্চিৎ কথকতা উৎকীর্ণ রয়েছে ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ শীর্ষক রচনায়। আল মাহমুদের কবিতা বাংলাদেশের মানুষের লোকায়ত জীবন, তাদের স্বপ্ন-কল্পনা, বাক-কৌশল ও প্রাত্যহিকতার সারাৎসার। কোনো মহৎ জীবন-কৌশল কিংবা দার্শনিক বীক্ষণ না থাকলেও কেবল শব্দকৌশল ও সরল জীবনের নান্দনিক উপস্থাপনায় তাঁর কবিতা বিশেষ তাৎপর্যে বাঙালির সমাদর লাভ করেছে। বাঙালি জীবনের বহিরঙ্গও যে কত বিচিত্র বর্ণিল তার শিল্পিত রূপায়ন ঘটেছে আল মাহমুদের কবিতায়। ‘আল মাহমুদের স্বর্ণলেখা’ শীর্ষক রচনায় তাঁর কবিতার শিল্প ও লোকনন্দন পরিবীক্ষণের প্রয়াস চালিয়েছি। এস এম সুলতার হাজার বছরের কৃষি-নির্ভর বাঙালি জনজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। তাঁর চিত্র কৃষিভিত্তিক জীবন প্রবাহকে সভ্যতার বিকাশধারা হিসেবে নয় বরং সভ্যতার একটি নবরূপ হিসেবে দেখিয়েছে। এখানে কৃষকের শরীরের শক্তির সঙ্গে যেনো ভেতরের শক্তিও প্রবল বিক্রমে বিকশিত। সুলতানের শিল্পকর্মের এ তাৎপর্য অভিনব এবং এটি কেবল বাঙালির গণ্ডিসীমায় নয় বিশ্বশিল্পের ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে চিহ্নিত। ‘সুলতানের রম্য অভিনিবেশ’ শীর্ষক রচনায় শিল্পীর কর্মকৌশল ও জীবন-ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কহলীল জিবরান লেবাননে জন্মগ্রহণকারী এক অমর কবি ও শিল্পীর নাম, যাঁকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক আলোচনা হয়েছে এমনকি বাংলাদেশেও তাঁর গুণমুগ্ধ লোকের সংখ্যা কম নয়। জিবরানের বিশেষত্ব তাঁর মরমী ভাবনা এবং হৃদয়গ্রাহী উচ্চারণ শৈলী। যে কোনো প্রেক্ষিত, ধরা যাক একজন বিপন্ন মানুষ কিংবা সদ্য স্বামীহারা কোনো রমণী। জিবরান এমন করে সে রমণীর নিঃসঙ্গতাকে প্রকাশ করেছেন যেনো তা ওই রমণীর মুখের কথা নয় বরং হৃদয়ের বিদীর্ণ ভাষণ। জিবরান তাঁর প্রতিটি রচনায় এমন স্বর প্রক্ষেপণ করেছেন আর আমি সেসবে এত বেশি আক্রান্ত যে, ভূমিকাতেও একটু উদ্ধৃত না করে থাকতে পারলাম না। ‘তারপর আমি দেখলাম দুজন শ্রমিক একটা কাঠের বাক্সের ওজন বহন করছে এবং তার পেছনে এক জরাজীর্ণ চেহারার নারী যে তার নবজাত শিশুকে বহন করছে বাহুতে। তাকে অনুসরণ করছে একটা কুকুর যে তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে একবার নারীর দিকে একবার বাক্সের দিকে তাকাচ্ছে। এটা ছিল খুবই সাদাসিধে একটা অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান। মৃত্যুর অতিথি ঠাণ্ডা সমাজের উদ্দেশ্যে জাগতিক পৃথিবী পরিত্যাগ করে যায় একজন দুস্থ স্ত্রী এবং নবজাতককে তার বেদনা ভাগাভাগি করার জন্য এবং একটি বিশ্বাসী কুকুর যার হৃদয় তার সঙ্গীর চলে যাওয়া সম্পর্কে জানতো।’ উম্মে কুলসুম আরব্য রজনীর গল্পের মতোই ঘোরলাগ এক কণ্ঠশিল্পীর নাম। মিশরের লোকেরা তাদের যে কোন প্রাচীন সম্রাজ্ঞীর চেয়েও যাঁকে অধিক ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। দুজন কবির কবিতায় এ নামের উল্লেখ দেখে আমার আগ্রহ জাগে এবং তারপর দেখলাম পৃথিবীর বহু বিখ্যাত শিল্পীকে তিনি আলোড়িত করেছেন। আরবি না জানলেও কেবল সুর ও সমুদ্রের নিনাদের মতো সম্মোহনী স্বর আমাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছে, বহু রাত কেটেছে তার অপার ধ্বনি-মূর্ছনায়। ‘উম্মে কুলসুম ও তার সহস্র রাত্রির গাথা’ শীর্ষক রচনায় গায়িকার সাংগীতিক উৎকর্ষ, বিশেষত্ব এবং আরববিশ্ব জোড়া তার প্রভাব ও স্বজাত্যপ্রীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি এজন্য যে, একজন শিল্পী তার কর্মসীমার বাইরে এসে সমাজের কি বিপুল কল্যাণ সাধন করতে পারেন তা জানান দেয়ার জন্য।
Writer |
|
Publisher |
|
ISBN |
9789849988083 |
Language |
Bengali / বাংলা |
Country |
Bangladesh |
Format |
Hardcover |
Edition |
1st |
First Published |
2025 |
Pages |
144 |