দ্যা ভেজিটেরিয়্যান - বুক রিভিউ

২০২৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখিকার বই

হান কাংয়ের দ্যা ভেজিটেরিয়ান একটি শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী সাহিত্যকর্ম, যা কোরীয় সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিনিধিত্ব করেছে। উপন্যাসটি মূলত মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, শারীরিক ও মানসিক সংকট, এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তিগত বিদ্রোহের দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এটি পাঠক ও সমালোচকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়েছে। ২০১৬ সালে উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং পরে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার অর্জন করে।

The Vegetarian by Han Kang

মূল কাহিনী:

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়ংহাই, একজন সাধারণ কোরীয় গৃহবধূ, যে একদিন হঠাৎ করেই নিরামিষভোজী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তটি তার পরিবারের সদস্যদের জন্য গভীর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার স্বামী, বাবা-মা, এমনকি তার নিজের বোনও এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। ইয়ংহাইয়ের নিরামিষভোজিতার পিছনের কারণ শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন নয়; এটি তার মানসিক ও শারীরিক স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠে। ইয়ংহাই তার স্বাভাবিক জীবনধারা থেকে বের হয়ে নিজেকে এক অচেনা ও অদ্ভুত জীবনযাত্রার মধ্যে ফেলে দেয়। এই নিরামিষভোজিতা তাকে ধীরে ধীরে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে থাকে, এবং সে তার চারপাশের মানুষদের কাছ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে।

প্রতীকী দিক:

উপন্যাসে খাবার এবং শরীরের প্রতীকী ব্যবহার হান কাংয়ের বুদ্ধিদীপ্ত রচনাশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খাবার এখানে শুধুমাত্র পুষ্টি নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তির প্রতীক। ইয়ংহাই খাবারের মাধ্যমে তার শরীর এবং মনকে সমাজের নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। তার নিরামিষভোজিতা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ হিসেবে উঠে আসে। এছাড়াও, শরীরের উপস্থাপনা এই উপন্যাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শরীরকে এখানে জীবনের উৎস এবং সমাজের নিয়ন্ত্রণের একটি মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ইয়ংহাই যখন তার শরীরকে সামাজিক বিধি-নিষেধ থেকে মুক্ত করতে চায়, তখন তা সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

মানসিক সংকট এবং বিদ্রোহ:

ইয়ংহাইয়ের এই নিরামিষভোজিতা মূলত তার মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। তার অবচেতন মনে জমে থাকা বিভিন্ন মানসিক আঘাত, চাপ এবং সামাজিক অবদমন তাকে এমন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়, যেখানে সে একমাত্র শরীরের উপরই তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। শরীরের উপর এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রচেষ্টা তাকে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে আমরা দেখি যে, ইয়ংহাই সমাজের নিয়ন্ত্রণ এবং বাধ্যবাধকতাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যদিও তার লড়াই অনেকটাই অন্তর্দ্বন্দ্বমূলক।

পারিবারিক সম্পর্কের সংকট:

ইয়ংহাইয়ের পরিবার উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার নিরামিষভোজিতা সিদ্ধান্ত তার স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের ভাঙনের সূচনা করে। ইয়ংহাইয়ের স্বামী তাকে শুধুমাত্র একজন স্ত্রীরূপে দেখে, যার দায়িত্ব তার জন্য সেবা করা। যখন সে এই দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে, তখন তার স্বামী তাকে আর গ্রহণ করতে পারে না। একইভাবে, ইয়ংহাইয়ের বাবা-মা তার সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে দেখে। তার পরিবারে একজন নিরামিষভোজী হওয়া সামাজিকভাবে অসম্ভব মনে হয়, এবং এটি তাদের মানসিক কাঠামোকে নাড়া দেয়। ইয়ংহাইয়ের বোনের সাথেও তার সম্পর্ক ক্রমশ জটিল হয়ে উঠে, কারণ সে তার বোনের এই পরিবর্তনকে বোঝার চেষ্টা করলেও, এক সময় তা মেনে নিতে পারে না।

শৈল্পিক রূপক:

হান কাংয়ের লেখনীতে শৈল্পিক রূপক এবং গভীর চিন্তার স্থান রয়েছে। 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' উপন্যাসে তিনি মানুষের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা, সামাজিক অবদমন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংকটকে রূপকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। ইয়ংহাইয়ের নিরামিষভোজিতা এবং তার শারীরিক বিদ্রোহ এক ধরনের শিল্পের প্রতীক হয়ে উঠে, যেখানে শরীর এবং মন একে অপরের সাথে মিশে যায়। তার মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা উপন্যাসের মূল কাহিনীর সাথে গভীরভাবে জড়িত, এবং পাঠকদের একটি গভীর অনুভূতির দিকে ঠেলে দেয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং স্বীকৃতি:

২০১৬ সালে 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' ইংরেজিতে অনুবাদ হলে এটি আন্তর্জাতিক পাঠক সমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। উপন্যাসটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয় এর ব্যতিক্রমী কাহিনীবিন্যাস, চরিত্রচিত্রণ এবং রূপকের ব্যবহারের জন্য। ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর এটি ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার অর্জন করে, যা কোরীয় সাহিত্যকে বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে পরিচিত করে তোলে। হান কাং, এই উপন্যাসের মাধ্যমে শুধু কোরীয় সমাজ নয়, বরং বিশ্বজুড়ে মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সংকটগুলোকে স্পর্শ করতে পেরেছেন।

উপসংহার:

হান কাংয়ের ‘দ্যা ভেজিটেরিয়ান’ কেবলমাত্র একটি উপন্যাস নয়; এটি মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক ও শারীরিক সংগ্রামের প্রতিফলন। উপন্যাসটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে গভীর দ্বন্দ্ব রয়েছে, এবং এই দ্বন্দ্ব অনেক সময় মানসিকভাবে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। হান কাংয়ের শক্তিশালী লেখনী এবং চরিত্রগুলোর গভীরতা এই উপন্যাসকে একটি অনন্য সাহিত্যকর্মে পরিণত করেছে, যা আমাদের মানব প্রকৃতির জটিলতা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

লেখক সম্পর্কে:


হান কাং দক্ষিণ কোরিয়ার একজন বিশিষ্ট লেখক, যিনি তার ব্যতিক্রমী ও বুদ্ধিদীপ্ত সাহিত্যকর্মের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে। হান কাংয়ের লেখায় মানুষের মানসিক অবস্থা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রতিফলন দেখা যায়। তার অন্যতম প্রধান সাহিত্যকর্ম হলো 'দ্যা ভেজিটেরিয়ান', যা ২০১৬ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার অর্জন করে। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে 'হিউম্যান অ্যাক্টস'

বাতিঘর থেকে ডিসকাউন্টে দি ভিজিটেরিয়্যান অর্ডার দিতে এখানে ক্লিক করুন। 

 

এক জীবন : স্বাধীনতার সূর্যোদয় (প্রথম পর্ব)